এ দেশে এখন মৌসুমে ও অমৌসুমে প্রচুর পরিমাণে টমেটো চাষ হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়সারা বিশ্বেই সবজি ফসলের মধ্যে আলু ও মিষ্টি আলুর পরেই সবচে বেশি উৎপাদিত হয় টমেটো। কেননা টমেটো একটি অত্যন- পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি। কাঁচা ও পাকা উভয় টমেটোই দেহের জন্য উপকারী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) বেশ কিছু টমেটোর জাত উদ্ভাবন করেছে যেগুলো অমৌসুমেও ফলে। এছাড়া কিছু হাইব্রিড জাত এ দেশে আসাতে সারা বছরই এখন টমেটো হচ্ছে। তবে দেশেও বেশ কিছু আধুনিক উচ্চফলনশীল জাতের টমেটো উদ্ভাবন করা হয়েছে যেগুলো ভাল ফলন দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এ দেশে এখন পঞ্চাশের ওপরে টমেটোর জাত চাষ হচ্ছে। বলা বাহুল্যএর বেশির ভাগই হাইব্রিড। অমৌসুমে ভাল ফল দেয়ার জন্য দিন দিন বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের টমেটো চাষের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে দিনাজপুরঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে গ্রীষ্মকালে টমেটো চাষের প্রবণতা বেড়েছে। কোন জাত চাষ করে লাভ বেশি হবে সে বিষয়টা এখন নির্ভর করছে মৌসুম ও বাজার দরের ওপর। তবে ভরা মৌসুমের চেয়ে আগাম বা নাবিতে এবং গ্রীষ্মকালে টমেটো চাষ করে বেশি লাভ করা সম্ভব।
 

মৌসুম অনুযায়ী এ দেশে চাষযোগ্য টমেটো জাতসমূহকে মোটামুটিভাবে নিম্নলিখিত শ্রেণীসমূহে ভাগ করা যেতে পারে-

আগাম জাত- এসব জাত শীতকালেই হয়তবে আগাম ফলে। আগাম জাতসমূহের বীজ বপন করা হয় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে। আগাম জাতসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বারি টমেটো ৪বারি টমেটো ৫রোমা ভিএফরোমারিওটিপু সুলতানগ্রেট পেলেডেল্টা এফ ১উন্নয়ন এফ ১পুষারুবীনিউ রূপালী এফ ১ ইত্যাদি।


ভরা মৌসুমী জাত- শীতকালে স্বাভাবিক সময়েই এসব জাতের গাছে ফল ধরে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বীজ বুনে অক্টোবর-নভেম্বরে এসব জাতের টমেটোর চারা রোপণ করা হয়। অধিকাংশ জাতই শীতকালে ফলে। এসব জাতের মধ্য থেকে মানিকরতনবারি টমেটো ৩বারি টমেটো ৬বারি টমেটো ৭বারি টমেটো ৯বাহারমহুয়া ইত্যাদি জাতকে বেছে নেয়া যেতে পারে।

নাবি শীত মৌসুমী জাত- এসব জাতের বীজ বুনতে হয় জানুয়ারিতেফল পাওয়া যায় মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। বাহাররোমা ভিএফরাজাসুরক্ষা ইত্যাদি জাত নাবি চাষের জন্য ভাল।


সারা বছর চাষের উপযোগি জাত- বছরের যে কোন সময় টমেটোর বীজ বুনলে চারা ও  সেসব চারা লাগালে গাছ হয় সত্যএমনকি সেসব গাছে ফুলও আসে। কিনসব জাতের গাছে ফল ধরে না। এজন্য সারা বছর চাষের উপযোগি জাত  যেমন বারি টমেটো ৬ (চৈতী) চাষ করা যায়। 
 

বীজ ও বীজতলার মাটি শোধন

টমেটো চাষ করা হয় চারা তৈরি করে। এজন্য বীজতলায় বীজ বুনে সেখানে চারা তৈরি করে নিতে হয়। টমেটো চাষে সফলতার জন্য কেনা বীজ বা ঘরে রাখা বীজ প্রথমে শোধন করে নিতে হবে। সম্ভব হলে বীজতলায় বোনার আগে অংকুরোদগম পরীক্ষাও করে নেয়া উচিত। একবার ফেলার পর বীজতলায় সেসব বীজ না গজালে বা কম গজালে কিংবা গজানো চারা রোগগ্রস- হলে ক্ষতি হবে। বীজের মধ্যে অনেকসময় রোগজীবাণু লুকিয়ে থাকে। যেমন আগাম ধ্বসা বা আর্লি ব্লাইট রোগমোজেইক ভাইরাসছত্রাকজনিত ঢলেপড়া ইত্যাদি রোগের জীবাণু বীজে থাকতে পারে। মাটিতে ফেলার পর পানি পেয়ে সেসব রোগজীবাণু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে চারা মারা যায়। আবার অনেকসময় বীজতলার মাটিতেও কিছু রোগজীবাণু থাকতে পারে। যেমন চারা ধ্বসা বা ড্যাম্পিং অফ রোগের জীবাণু। এসব রোগজীবাণুও চারাকে আক্রমণ করতে পারে। সেজন্য বীজতলার মাটিও শোধন করে নিলে ভাল হয়।

বীজ শোধন করা যেতে পারে কয়েক পদ্ধতিতে। গরম পানিতে ভিজিয়ে বীজ শোধন করা সহজ। ৫০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার গরম পানিতে ৩০ মিনিট টমেটোর বীজ ভিজিয়ে রাখলে বীজের গায়ে লেগে থাকা বা ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জীবাণু মরে যায়। এরপর ভিজে যাওয়া বীজ তুলে ছায়ায় শুকিয়ে বপন করতে হবে। কিছু গাছগাছড়ার রস দিয়েও বীজ শোধন করা যায়। রসুনের রস দিয়ে এ কাজ করা যেতে পারে। এছাড়া ছত্রাকনাশক দিয়েও বীজশোধন করা যায়। আর বীজ তলার মাটি চাষ দিয়ে তাতে জৈব সার মিশিয়ে পলিথিন দিয়ে দুসপ্তাহ ভাল করে ঢেকে রেখে দিলে সূর্যের তাপে মাটিতে থাকা অনেক জীবাণু মরে যায় ও বীজতলার মাটি শোধন হয়ে যায়। সময় না থাকলে বীজতলার মাটির উপরে ৩ ইঞ্চি পুরু করে কাঠের গুঁড়া বিছিয়ে আগুন দিলে সে তাপেও রোগ জীবাণু নষ্ট হয়। 
 

চারা তৈরি
সরাসরি জমিতে বীজ বুনেও টমেটো চাষ করা যায়। তবে দ্রুত ভাল ফলন পাওয়ার জন্য আলাদাভাবে চারা তৈরি করে সেই চারা মূল জমিতে লাগাতে হবে। এজন্য রোদযুক্ত উঁচু জায়গায় পরিস্কার করে ভালভাবে মাটি চাষ দিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হবে। চাষের পর মাটি সমতল করে ১ মিটার চওড়া করে বেড বানাতে হবে। বেড খুব বেশি লম্বা না করে ৩-৫ মিটার করা ভাল। এতে পরিচর্যার সুবিধে হয়। ছিটিয়ে বীজতলায় বীজবপন করা যায়। ছিটিয়ে বপনের জন্য সাধারণত: প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ১০০-১৫০ গ্রাম বীজ লাগে। বীজ থেকে চারা গজাতে ৬-১৪ দিন লাগে। শীতকালীন টমেটো চাষের জন্য বীজ বুনতে হবে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে। আগাম চাষের জন্য শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বীজ বুনতে হবে।
 

জমি তৈরি
জমি ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে নিতে হয়। গ্রীষ্মকালে টমেটো চাষের জন্য ২০-২৫ সেন্টিমিটার উঁচু এবং ২৩০ সেন্টিমিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হয়। সেচ দেওয়ার সুবিধার্থে ২টি বেডের মাঝে ৩০ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হয়।

 

চারা রোপণের দূরত্ব

প্রতিটি বেডে ২ সারি করে ৬০x৪০ সেন্টিমিটার দূরত্বে ২৫-৩০ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হয়


রোপণ সময়
শীতকালীন টমেটোর জন্য মধ্য কার্তিক থেকে মাঘের ১ম সপ্তাহ (নভেম্বর থেকে মধ্য জানুয়ারি) পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। তবে আগাম চাষের জন্য রোপণ সময় এগিয়ে আনতে হবে। আগাম চাষের জন্য ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এবং নাবি চাষের ফাল্গুণ মাসে এবং গ্রীষ্মকালীন চাষের জন্য জন্য চৈত্র-বৈশাখ মাসে চারা রোপণ করতে হবে।

 

সারের পরিমাণ
টমেটো উৎপাদনের জন্য হেক্টর প্রতি নিম্নরূপ সার প্রয়োগ করতে হয়। তবে মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ উত্তম।

 

সারের নাম           সারের পরিমাণ (কেজি/শতক) সারের পরিমাণ (কেজি/হেক্টর)

ইউরিয়া               ২.০-২.৪ ৫০০-৬০০          

টি এস পি              ১.৬-২.০ ৪০০-৫০০          

এমওপি                ০.৮-১.২ ২০০-৩০০          

গোবর                 ৩০-৪৫   ৮-১২ টন 
 

সার প্রয়োগ পদ্ধতি
অর্ধেক গোবর সার ও সবটুকু টিএসপি সার শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। অবশিষ্ট গোবর চারা লাগানোর পূর্বে  গর্তে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সমান দুই কিস্তিতে পার্শ্বকুশী ছাঁটাই এর পর চারা লাগানোর ৩য় সপ্তাহে ও ৫ম সপ্তাহে রিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হয়। ঘাটতি থাকলে জিপসামজিংক সালফেটবোরিক এসিড পাউডার এবং ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সারও প্রয়োগ করতে হবে।


অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
মরা পাতা ছাঁটাইসহ  আকৃতি বাঁশের খুটি টমেটো গাছের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি কাজ। এ ছাড়া প্রয়োজনে সেচ দেয়াও যেতে পারে। ভাইরাস রোগ দেখা দিলে গাছ তুলে ফেলতে হবে। অন্যান্য রোগ প্রতিকারের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। তেমনি পোকামাকড় দেখা দিলেও সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। টমেটো গাছের বৃদ্ধির কোন ধাপে কি কি রোগ বা পোকার আক্রমণ হতে পারে তা অধ্যায় ৩-এর তালিকা থেকে দেখে নেয়া যেতে পারে।

 

ফসল সংগ্রহ ও ফলন
জাত ও লাগানোর সময়ের উপর নির্ভর করে ২-৪ মাসের মধ্যেই ফসল তোলার সময হয়। টমেটো পাকা ও কাঁচা উভয়ই অবস্থায়ই তোলা যায়। তবে দূরে পাঠানোর জন্য একেবারে পাকা টমেটো তোলা উচিত নয় এবং পাকানোর জন্য বা টমেটোর ভাল রঙ আনার জন্য কৃত্রিম হরমোন ব্যবহারও ঠিক নয়। প্রতি হেক্টরে ফলন ২০-৪০ টন